![]() |
বঙ্গবন্ধু নিজেকে একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মুসলিম হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসতেন। তিনি জীবদ্দশায় ব্রিটিশ কলোনি দেখেছেন, অবিভক্ত ভারতবর্ষ দেখেছেন, অখন্ড পাকিস্তান দেখেছেন। কিন্তু সারাটা জীবন তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন একজন গর্বিত ‘বাঙালি’ হিসাবে।
তিনি জীবন সংগ্রামে ভারতবর্ষে সময় কাটিয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু তার মুখ থেকে জীবনে কখনো ‘বাঙলা ভাষা’ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা উচ্চারিত হয়নি। (বিশেষ প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ করেছেন)
গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো এতো স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধুর মত জনপ্রিয় নেতার সৃষ্টি হয়নি। বঙ্গবন্ধু অনেকটা কবি সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতার মত। কবি সুকান্তের চিন্তায় আঠারো বছর বয়স যেমন দুঃসহ এক বয়স। যে বয়স কোনো বাঁধা মানতে চায় না, মাথা নোয়াবার চায় না, পথে-প্রান্তরে ছুটে তুফান গতিতে। তেমনি বঙ্গবন্ধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আঠারো বছর বয়সেই প্রথম আদালতের সাজায় জেল খেটেছেন। (প্রথম কারাগারে প্রবেশ করেছিলেন এগারো/বারো বছর বয়সে)
বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। তার মধ্যে ১৪ বছর তিনি জেলে কাটিয়েছেন, ১৮ বছর কিশোরবেলা কাটিয়েছেন, ৩ বছর স্বাধীন বাঙলায় কাটিয়েছেন। জীবন থেকে এই ৩৫ বছর বাদ দিলে বাকী রইলো মাত্র ২০টি বছর। এই ২০ বছরে তিনি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভালবাসার পাত্র হয়েছেন, আশা-ভরসার প্রতীক হয়েছেন, মুক্তি সংগ্রামের অগ্রদূত হয়েছেন। মাত্র ২০ বছর জীবন সংগ্রাম করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিশ্বাস অর্জন করা চাট্টিখানি কথা নয়।
বঙ্গবন্ধু তার জীবনে কখনো অন্যায়ের সাথে আপোস করেন নাই। কারণ তিনি জানতেন অন্যায়ের সাথে আপোস করা মানে বাঙালির বিশ্বস্ততার সাথে প্রতারণা করা। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যার ফলে তিনি সহ মোট পাঁচজন ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল হয়। সবাই ১৫ রুপী জরিমানার মাধ্যমে মুচলেকা দিয়ে তাঁরা ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাতে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রাখতে রাজী হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘১৫ রূপী জরিমানার মাধ্যমে মুচলেকা দেওয়া মানে অন্যায়ের সাথে আপোস করা। কিন্তু আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।’
বঙ্গবন্ধু কখনো ক্ষমতার লোভ করেন নাই। তিনি কখনো নেতা হওয়ার লোভে রাজনীতি করেন নাই। তিনি সবসময় সাধারণ বাঙালির প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে তিনি ‘ছাত্রলীগ’ নামে ছাত্রসংগঠন সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনোদিন তার গড়ে তোলা ছাত্রলীগের পদ-পদবিতের অধিষ্ঠিত হন নাই। কারণ তিনি জানতেন পদ-পদবিতে অধিষ্ঠিত হলেই জনগণের সামনে নেতা হওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধু জানতেন কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কিভাবে প্রতিবাদের হুংকার দিতে হয়। তিনি বলেছিলেন, “When you play with a gentleman, you play like a gentleman. But when you play with bastards, make sure you play like a bigger bastard. Otherwise, you will lose.”
বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে এই বাঙলার মাটিকে ভালবাসতেন। এই বাঙলার মাটি ছিলো অস্তিত্বের প্রতীক। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকাকালীন তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেল তবে মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার বাঙলার মাটিতে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছাইয়া দিও।’
বঙ্গবন্ধু কখনো স্বাধীন বাঙলার সার্বভৌমত্বের সাথে কোনো আপোস করেন নাই। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বিমানে তুলে দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘আমাদের সাথে কি একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না?’
বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ‘দেখো ভুট্টো এ বিষয়ে আমি এখন একদমই আলোচনা করতে চাই না। তবে বাঙলার মাটিতে পৌঁছানো মাত্র তোমার প্রশ্নের জবাব তুমি পেয়ে যাবে।’
স্বাধীন বাঙলার পা রেখে তিনি ভুট্টোর প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘ভুট্টো তোমরা সুখে থাকো। আমাদের সুখে থাকতে দাও। তোমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক আমাদের হতে পারে না। তুমি রিয়েলিটি মেনে নাও। আমার দিকে চিন্তা-ভাবনা না করে নিজের মানুষকে বাঁচাও। কারণ আমি জানি তোমার বারোটা বেজে গেছে।’
বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন সাধারণ বাঙালির জন্য চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলো সাধারণ খেটে-খাওয়া বাঙালি। বাঙালির কথা ভেবে তিনি কখনো তার পরিবারের কথা চিন্তা করেন নাই। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর তিনি লন্ডন থেকে তাজউদ্দীনকে ফোন করে সর্বপ্রথম বলেছিলেন, ‘আমার বাঙলার মানুষ কেমন আছে?’
বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘I feel for my country and my people and then my family. I love my people more. I suffered for my people and you have seen how my people love me.’
বঙ্গব্ন্ধুর জীবনটা ছিলো বাঙলা আর বাঙলিকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধুকে এক সাক্ষ্যাৎকারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, ‘What is your strength?’
বঙ্গবন্ধু নির্ধিধায় অকপটে বলেছিলেন, ‘My greatest strength is the love for my people.’
এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘What is your greatest weakness?’
প্রশ্নটা শুনে বঙ্গবন্ধু খানিক চুপ হয়ে গেলেন। কখনো তিনি এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন সেটা হয়তো তিনি ভাবেননি। কারণ তিনি জীবনে কখনো তার দূর্বলতার কথা চিন্তা করেননি। একটু ভেবে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘My greatest weakness is that I love my people too much.”
বঙ্গবন্ধু কখনো তার জীবনের মায়া করতেন না। তিনি একবার বলেছিলেন, এই দেশের জন্য প্রতিদানে তিনি তার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও পরিশোধ করতে চান। তিনি কল্পনাতেও কখনো বিশ্বাস করতেন না বাঙালি তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে। তাই তিনি কখনো তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য গণভবনে থাকতেন না। ধানমন্ডির ৩২ বাসাতেও তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার চিন্তা করেননি। বিভিন্ন সূত্র থেকে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে জানানো হলে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন, ‘বাঙালি আমাকে হত্যা করবে!!! এ কথা আমি ভুলেও বিশ্বাস করি না। হাহাহা!!!!!’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালবাসতে কোনো রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই, কোনো দলের সমর্থক হওয়ার প্রয়োজন নেই, কোনো ভিন্ন মতাদর্শের হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাকে ভালবাসতে হলে তার নামটাই যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধু কোনো নির্দিষ্ট দলের নন, গোষ্ঠীর নন, গোত্রের নন। তিনি পুরো বাঙালি জাতিস্বত্ত্বার মহাপুরুষ।
বঙ্গবন্ধুকে কখনো দুই-চার লাইনে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সুকান্তের প্রগতিশীল, ফ্যাসিবিরোধী আর সংগ্রামের কবিতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নজরুল প্রবন্ধের উদ্দম, শৌর্য, সাহস আর দুর্দমনীয় স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রবি ঠাকুরের মানব প্রেমের চিরায়ত কাব্যগ্রন্থ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জয়নুলের রূপসী বাঙলার তুলির আঁচড়।
সবশেষে বলতে চাই, আমি যেহেতু বাংলাদেশের দালাল সেহেতু আমি বঙ্গবন্ধুর দালাল। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

অস্থির লিখেছেন ভাই।
ReplyDeleteঅসাধারণ ভাবে কথাগুলো ব্যক্ত করতেছেন!
ReplyDelete