ওয়েব সিরিজে জেন্টলম্যান ফারুকীর আড়ম্বরপূর্ণ অভ্যুদ্বয়

  

"লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান"


মুভি কিংবা সিরিজ নিয়ে আমি পূর্বে কখনো রিভিউ লেখার চেষ্টা করিনি। বিষয়টা আমার কাছে বরাবরই জটিল মনে হয়। একজন নির্মাতার হাতে তৈরী শিল্পকর্ম নিয়ে রিভিউ করা আমার কাছে খানিকটা দুঃসাহসের অভিপ্রায়। কিন্তু “লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান” ওয়েব সিরিজটি দেখার পর নিজ থেকে কিছু লেখার তাড়না অনুভব করি। লেখার প্রচন্ড তাড়না অনুভব করলেও ঠিক কিভাবে গুছিয়ে লিখবো সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে বিখ্যাত মুভি ক্রিটিক এবং রিভিউয়ার মাইকেল ফিলিপসের একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, “কোনো ফিল্ম ক্রিটিক কিংবা রিভিউ করার জন্য অন্তত তিন বার সেই ফিল্মটি দেখা উচিত। প্রথমবার উপলব্ধি তৈরী হবে, দ্বিতীয়বার অনুধাবন করতে হবে এবং তৃতীয়বার অন্বেষণের চেষ্টা করতে হবে।”


মাইকেল ফিলিপসের সেই কথা অনুযায়ী “লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান” আবারও দেখা শুরু করি। সিরিজটি দ্বিতীয়বার সম্পূর্ণ দেখলেও তৃতীয়বার গূরুত্বপূর্ণ অংশগুলো টেনেটেনে দেখার চেষ্টা করেছি। ফিলিপসের মত বিখ্যাত ক্রিটিক হলে হয়তো সিরিজটি তৃতীয়বার সম্পূর্ণ দেখে ফেলতাম। কিন্তু পরবর্তীতে চিন্তা করলাম আমি নিজে একজন আনাড়ি মস্তিষ্কের মানুষ। সিরিজটি বারবার দেখলেও আমার মস্তিস্কের যতটুকু পরিসীমা ঠিক ততটুকুই আমি লিখতে পারবো। তবে মাইকেল ফিলিপসের কথায় আমি যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছি। একটি মুভি বা সিরিজ দ্বিতীয়বার দেখলে অনেক কিছুই নতুন করে পরিলক্ষিত হয়।


“লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান” ওয়েব সিরিজ প্রথম থেকে দেখা শুরু করার আগে আমি ভিন্ন একটি এপিসোডের ২-৩ মিনিট অংশ দেখার চেষ্টা করি। ভিন্ন একটি এপিসোডের অংশবিশেষ শুরুতেই দেখার পিছনে একটি গূরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য আছে। কারণ আমি সেখানে নির্মাতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য পূর্বের ন্যায় বিরাজমান অবস্থায় আছে নাকি সেটা খুঁজতে চেষ্টা করি। নির্মাতার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মুভি বা সিরিজের যেকোনো অংশবিশেষ দেখে দর্শক যেন সহজেই বুঝতে পারে শিল্পকর্মটি কোন ব্যক্তির দ্বারা নির্মিত হয়েছে। যেহেতু দীর্ঘ চার বছর পর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দর্শকদের সামনে তার নতুন নির্মাণ নিয়ে হাজির হয়েছে সেহেতু তার নির্মাণ শৈল্পের কারুকার্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যতায় উনিশ-বিশ পরিবর্তন হতেই পারে। (যদিও তিনি সবসময় নির্মাণ কাজের মধ্যেই ব্যস্ত ছিলেন) কিন্তু আনন্দের বিষয় হচ্ছে তার নির্মাণ স্বকীয়তা ঠিক আগের মতই আছে। এই ওয়েব সিরিজের যে কোনো অংশবিশেষ আউট অফ কনটেক্সট দেখলেও আমি বুঝতে পারতাম এটা ফারুকী ভাইয়ের হাতে নির্মিত কাজ। 


একজন ফিল্মমেকারের জীবনে সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে আর্টওয়ার্কে নিজস্ব সিগনেচার তৈরী করা। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ নির্মাতাদের দুইটা ভিন্ন কাজ দেখলে সেটা যে একই ব্যক্তি দ্বারা নির্মিত; বিষয়টা অনুধাবন করা অনেকটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বাঙলা ভাষাভাষী ফিল্মমেকারদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি নিজস্ব সিগনেচার তৈরী করতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম সত্যজিৎ রায়, হীরালাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, ঋতুপর্ণ ঘোষ, জহির রায়হান, হুমায়ূন আহমেদ সহ আরো কিছু কীর্তিমান নির্মাতা। উল্লেখিত ব্যক্তিদের নির্মিত চলচিত্রের যেকোনো একটি অংশ দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব এটি কার নির্মিত কাজ। কারণ তাদের প্রত্যেকের নির্মিত কাজে আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। যা তাদের নির্মাণকে দর্শকের সামনে স্বকীয় করে তোলে।


বর্তমান সময়ের ফিল্মমেকারদের মধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর নির্মাণ শৈল্পিকতায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়। তার প্রত্যেকটি নির্মাণ শৈল্পের মাঝে আলাদা এবং অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। চলচিত্র এবং নাট্যনির্মাণে তার নান্দনিক উপায়ে গল্প বলার প্রয়াস, কাহিনীর ঘটনাপ্রবাহে সঠিক চরিত্রের বিন্যাস, সৃজনশীল সিনেমাটোগ্রাফি, এলিজেন্ট কালার স্কিম, ইউনিক ফ্রেমিং টেকনিক সহ আরো বেশ কিছু বিষয় তার নির্মিত কাজে ইতিমধ্যে নিজস্ব সিগনেচার তৈরী করেছে।





ওয়েব সিরিজের বিষয়ে মূল আলোচনায় আসা যাক। লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান ওয়েব সিরিজটি কোনো বিশেষ জনরায় পৃথক করা কঠিন। ওয়েব সিরিজটির প্রথম চার এপিসোড ড্রামা এবং শেষ চার এপিসোড ক্রাইম জনরায় নির্মিত হয়েছে। ড্রামাতে সাব ক্যাটাগরি হিসাবে সোশ্যাল ক্রাইসিং এবং ডিলেমা চিত্রায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্রাইমের সাব ক্যাটাগরি হিসাবে ডিটেকটিভ এবং মার্ডার মিস্ট্রি চিত্রায়িত করা হয়েছে। এখানে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে সোশ্যাল ডিলেমা এবং মার্ডার মিস্ট্রি ক্যাটাগরি একে অপরের সাথে কোরিলেটেড। যা গল্পের উৎকর্ষতা এবং চঞ্চলতা তৈরী মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। অপরদিকে সোশ্যাল ক্রাইসিং এবং ডিটেকটিভ ক্যাটাগরি গল্পের মজবুত গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোমেন্টাম তৈরীতে সহায়তা করেছে।


মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর চলচিত্র এবং নাট্য নির্মাণে শুরু থেকেই আরবান ইয়্যুথের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তার সৃষ্টিকৃত প্রত্যেকটি গল্পে মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা সংকট এবং জটিলতাকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি সচরাচার ওভার পিরিয়ড ড্রামা কিংবা ফিকশনাল ড্রামা ইলাস্ট্রেট করেন না। বরং সমসাময়িক জীবন পরিক্রমার উপর ভিত্তি করে রিয়েলেস্টিক পিরিয়ড ড্রামা সবচেয়ে বেশী নির্মাণ করেছেন। অধিকাংশ ড্রামা নির্মাণে ক্রুশিয়াল এলিমেন্ট হিসাবে ‘স্যাটায়ার’ এবং ‘হিউমার’ ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে হিউমার প্রয়োগের মাধ্যমে স্যাটারিকাল ভাষায় বিভিন্ন ভন্ডামিকে বিদ্রুপ করে সমাজের নানা অসঙ্গতি চিত্রায়িত করা হয়েছে।



মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাম্প্রতিক সময়ের নির্মাণে আরবান ইয়্যুথ এবং শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের সংকট এবং জটিলতার প্রভাব বিদ্যমান থাকলেও কিছু বিষয়ে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।  তিনি সাম্প্রতিক গল্পগুলোতে স্যাটায়ার একদম কমিয়ে দিয়েছেন। তার সর্বশেষ নির্মিত ‘ডুব’ চলচিত্র এবং ‘আয়েশা’ নাটক স্যাটারিকাল টোন একদম নেই বললেই চলে। যদিও ‘আয়েশা’ নিজস্ব স্টোরি নয় নয় এবং ভিন্নধর্মী একটি কাজ। স্যাটায়ারের পরিবর্তে সাম্প্রতিক সময়ে তার নির্মিত গল্পের কাহিনীতে নীরবতা, মনঃকষ্ট, অন্তর্জ্বাল, দুঃখ গোপনের তীব্র হাহাকার, যন্ত্রণার বোবা আর্তনাদ সন্নিবেশিত জীবনবোধের গভীরতা খুব সুনিপুণভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।



লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান ওয়েব সিরিজের গল্পের কাহিনীতে একই ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। গল্পের মূল চরিত্র সাবিলা অন্যায়ের শিকার হয়ে তার জীবন বিষাদের নীল যন্ত্রণায় ম্লান হয়ে উঠে। অন্যদিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির পারিবারিক জীবনে তৈরী হয় নানা সংকট আর জটিলতা। গল্পের কাহিনীতে স্যাটায়ারের ব্যবহার থাকলেও সেটা খুব সীমিত। যা মূলত গল্পের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়েছে।


ওয়েব সিরিজের একদম শুরুতেই নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অত্যন্ত বিচক্ষণতায় সাবিলা চরিত্রে মনস্তত্ত্বের বিনিশ্চয়তা চিত্রায়িত করেছেন। গল্পের কাহিনীতে সাবিলা চরিত্রটি বিভিন্ন সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকবে; সেটা শুরুর দৃশ্যপটে নামাজের সময় বাবার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির মাধ্যমে আলেখ্য হয়েছে। অন্যদিকে সাবিলাকে শুধুমাত্র ভিক্টিম চরিত্রে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে গল্পে চিত্রায়িত করা হয়নি। গল্পের কাহিনীতে সাবিলা একজন আত্মনির্ভরশীল, কর্মঠ, পিতৃভক্ত, প্রগতিশীল, উদারতাবাদী চিন্তাধারার নারী চরিত্রে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে। আমাদের সমাজে নারীদের বিবাহিত জীবন শুরু হওয়ার পর স্বামীর উপার্জিত টাকার উপর নির্ভর না করে, নিজের অসুস্থ্য বাবাকে সঙ্গে রেখে দেখভাল করা নারীদের সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন আছে হয়তো। সেখানে সাবিলা চরিত্রটি আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মাধ্যমে অনন্য নারী চরিত্রে অলঙ্কিত করা হয়েছে।





নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ওয়েব সিরিজে নারীকে বিপ্লবী চরিত্রে উপস্থাপন করার জন্য কোনো অবাস্তব দৃশ্যপটের সূত্রপাত করেন নাই। সাবিলা তার নিজ অফিসে হেনস্থার শিকার হওয়ার পর যথারীতি আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে। তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগতে থাকে। এমনকি থানায় যাওয়ার পর সাবিলা তার কলিগের আশ্বাসে নিজের সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তে পরিবর্তন করে ফেলে। আমাদের নিত্যদিনের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীরা বাস্তবিক পক্ষে এভাবেই হেনস্থা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। সাবিলাকে বিপ্লবী নারী চরিত্রে দৃশ্যায়নের মাধ্যমে অবাস্তব গল্প তৈরী না করার জন্য নির্মাতার চিন্তাশক্তিকে প্রশংসা করতেই হয়। কারণ সাবিলার অসহায়ত্ব এবং পরাধীনতা চিত্রায়িত করার মাধ্যমে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আগ্রাসী আচরণ, হীন মানসিকতা, মিসোজিনিস্টদের ঘৃণ্য রুচিবোধ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।



ওয়েব সিরিজ নিয়ে আরো নানামুখী বিশ্লেষণের আগে একটু ভিন্নদিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ইন্টারনেট ঘাটলে দেখা যায় এই সিরিজ নিয়ে কিছু মানুষ নেতিবাচক মন্তব্যও করেছেন। তাদের নেতিবাচক মন্তব্যের প্রধান কারণটা হচ্ছে, ‘বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ক্যামেরার ফ্রেমে নানারকম দৃশ্য দীর্ঘসময় চিত্রায়িত করার দরুণ অহেতুক সময় নষ্ট করা হয়েছে।’


বাস্তবতা হচ্ছে চিরায়ত রীতিধারার ছাইপাঁশ জিনিস গলাধঃকরণ করতে করতে ফিল্ম জগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অর্বাচীনই রয়ে গেছে। একজন নির্মাতার নানাবিধ উপায়ে গল্প বলার ভঙ্গি থাকতে পারে। গল্প শুধু চরিত্রের কথোপকথনের মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌঁছাতে এমন কোনো প্রচলিত নিয়ম নেই। চরিত্রের কথোপকথন ছাড়াও বিভিন্ন সুক্ষাতিসুক্ষ বিষয় ব্যবহার একটি গল্প তুলে ধরা যায়। বরং একজন নির্মাতা যদি চরিত্রের কথোপকথন ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায়ের মাধ্যমে গল্পকে দর্শকের কাছে প্রকাশ করতে না পারে তবে সেটা নির্মাতার কারিগরি অদক্ষতা এবং সৃজনশীলতার অভাব।


লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান ওয়েব সিরিজে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিভিন্ন দৃশ্য ক্যামেরার ফ্রেমে চমৎকারভাবে চিত্রায়িত করতে পেরেছেন। অনেক সময় নীরবতা উপভোগ করতে হয়, চরিত্রকে প্রকৃতি এবং আত্মার সন্নিবেশে অনুভব করতে হয়, নিজেকে প্রকাশ করতে অনেক সময় নীরবতা বড় হাতিয়ার। এই ওয়েব সিরিজে চমকপ্রদে উপায়ে বিভিন্ন দৃশ্যকে শুধুমাত্র ক্যামেরার ফ্রেমে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি এখানে একটি দৃশ্যের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সাবিলা যখন রেস্টুরেন্টে লরাকে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে বলে দেয় তখন এক মূহুর্তেই লরা স্তব্ধ হয়ে যায়। তার মুখের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিলো নিজের বাবার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ যেন উপচে পড়ছে। সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তটা তৈরী হয় যখন সাবিলাকে বিদায় জানাতে লরা সিঁড়িতে নেমে এসেছিলো। এই দৃশ্যে লরার মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু সাবিলার প্রতি লরার বাড়িয়ে দেওয়া হাতের যুগলবন্দী স্পর্শ এক চমকপ্রদ দৃশ্যের অবতারণা করে। শুধুমাত্র ঐ হাত জোড়ার দিকে তাকিয়ে নিমিশেই মনের ভিতর কেমন যেন প্রশান্তি কাজ করছিলো!




এই ওয়েব সিরিজে গল্পের মূল থিম ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে মোটিফের যথার্থ প্রয়োগের মাধ্যমে নির্মাতা গল্পের শক্তিশালী ভিত এবং উপযোগিতা তৈরী করতে পেরেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজের অতি আপনজন হলেও ভিক্টিম ব্লেমিং করা যাবে না। এখানে সাবিলার প্রতি লরার সৌহাদ্যপূর্ণ আচরণের বিষয়টি মোটিফের যথার্থ প্রয়োগে ব্যক্ত হয়েছে। এরকম আরো বিভিন্ন বিষয় গল্পে চমকপ্রদভাবে উঠে এসেছে। 


এছাড়া হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগা বেশকিছু চোখ এড়িয়ে যাওয়া বিষয়েও সূক্ষ্ম মোটিফের সাথে মেটাফোর ব্যবহার করা হয়েছে। চেয়ারম্যান খাইরুল আলম সাহেব নিজের ঘরবাড়ি রেখে মাঝেমাঝেই পাঁচ তারকা আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই দর্শকের মনে প্রশ্ন তৈরী পারে, কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া খাইরুল আলম সাহেব কেন মাঝেমাঝেই আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করেন? আবাসিক হোটেলের রুমে খাইরুল আলম সাহেবের অবস্থানের বিষয়টা যখন স্ক্রিনে না দেখিয়েই দর্শকের সামনে প্রথমবার উপস্থাপন করা হয়; তখন অধিকাংশ দর্শকের মস্তিষ্কে আপনা-আপনি ধারণা তৈরী হয়েছিলো তিনি হোটেল রুমে কোনো নারীর সাথে রিফ্রেশিং মোমেন্ট অতিবাহিত করছেন। কিন্তু ওয়েব সিরিজে কখনোই খাইরুল আলমের সাথে হোটেল রুমে কোনো নারীকে দেখা যায়নি। মূলত নির্মাতা এখানে আরেকটি নারী চরিত্র দেখানোর প্রয়োজন অনুভব করেনি। কারণ তিনি হোটেলের ‘৫০১’ রুম নাম্বারটি বেছে নিয়েছে'। অপরদিকে খাইরুল সাহেবের স্ত্রী এসিসট্যান্ট মারফত হোটেলে রাত্রিযাপনের সংবাদ পেয়ে কেমন যেন একটা রিএ্যাক্ট করে বসেন। এখানে মোটিফ আর মেটাফোরের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারের দ্বারা খাইরুল সাহেব কেন আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করেন সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়! 


গল্পে বিভিন্ন সময় হিউমার প্রয়োগের মাধ্যমে বেশ কিছু গূরুত্বপূর্ণ  বিষয়ে স্যাটায়ার করা হয়েছে। সেইসব ব্যাঙ্গাত্মক বিষয় আমাদের গোঁড়া সমাজব্যবস্থার জন্য গূরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সাংস্কৃতিক চর্চার বিষয়ে হুজুরের বিরূপ মন্তব্য, ভিক্টিম ব্লেমিং করার জন্য নারীর চরিত্র হননে উকিলের চেষ্টা, মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী মানুষের জীবন মূল্যের বিষয়গুলোর মত ছোটছোট বার্তার তাৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার ছিলো।


লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান ওয়েব সিরিজে সবচেয়ে দূর্দান্ত অভিনয় করেছে মিজু চরিত্রে অভিনয় করা হাসান মাসুদ। এই চরিত্রের মাধ্যমে সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অসঙ্গতি আর দুর্নীতির বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মেটাফরিক উপায়ে বাস্তবিক বিষয়ের পাশাপাশি অনেক উচ্চ পর্যায়ের অনৈতিক কর্মকান্ডের বিষয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে।


এই সিরিজের শেষ চারটি এপিসোড অর্থ্যাৎ শেষ অর্ধাংশ মূলত ক্রাইম জনরার অন্তর্ভুক্ত। কিছু মানুষ অভিযোগ করেছেন, শেষ চারটি পর্বে অহেতুক বিষয়াদি সংযোজন করে ক্রাইম পেট্রোলের মত দ্রুততার সাথে দেখানো হয়েছে। এখানে আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, সিরিজে দুইটি আলাদা জনরা সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাসে গল্পটি শেষ করার জন্য মূলত এই সমস্যাটা মনে হচ্ছে। কারণ প্রথম চারটি পর্ব ছিলো সোশ্যাল ক্রাইসিস এবং ডিলেমা সংক্রান্ত ড্রামা। ড্রামার সংক্রান্ত সকল ক্যাটাগরির স্ক্রিনপ্লে স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা স্লো হয়। অপরদিকে ডিটেকটিভ ক্রাইম জনরার স্ক্রিনপ্লে স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা ফাস্ট হয়। তাই সিরিজে খানিকটা স্লো স্ক্রিনপ্লে দেখতে দেখতে হুট করেই যখন স্বাভাবিকের তুলনায় ফার্স্ট স্ক্রিনপ্লে চোখে পড়ে তখন একটু অস্বাভাবিক মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।


সিরিজে ক্রাইম নির্ভর অংশটুকু অনেকের ভাষায় ক্রাইম পেট্রোলের মত দেখানো হয়েছে অভিযোগ থাকলেও; আমি মনে করি নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যথার্থ কাজটাই করেছেন। ক্রাইম পেট্রোল অর্ধেক অংশ দেখেই দোষী ব্যক্তিতে খুব সহজে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু "লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান" ওয়েব সিরিজে সেই কাঙ্খিত দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার জন্য একদম শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আসামী ধরা পরার একদম আগ মূহুর্ত পর্যন্ত একবারের জন্যেও মনে হয়নি উনিই সেই দোষী ব্যক্তি। ঠিক এখানেই নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিরিজটি নির্মাণের সার্থকতা অনুধাবন করা যায়।


এই সিরিজটি শেষ হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিষফোঁড়ার ন্যায় একটি বার্তা প্রয়োগের মাধ্যমে। এতো অন্যায়, লাঞ্ছনা, নিগ্রহ, অবহেলার সাথে যুদ্ধ করেও বিষাদে ম্লান হওয়া সাবিলা চরিত্রটি হেরে যায় 'মেইল ইগো' নামের সামাজিকভাবে সংক্রমিত কাপুরুষের ন্যায় চারিত্রিক ব্যাধির কাছে। সিরিজটি শেষ করার পর আমার কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে, "মানুষের জীবনে সবচেয়ে মারাত্মক মানসিক ব্যাধি হয়তো ইগো।"


সবশেষে এতো সুন্দর একটি ওয়েব সিরিজ তৈরী করার জন্য মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ভাইকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আশা করি পরবর্তী আকর্ষণের জন্য আমাদের আবার ৪ বছর পরপর অপেক্ষা করতে হবে না। আমরা প্রতি বছর আপনার চমৎকার কাজ দেখে জীবনকে আরো আনন্দময় করতে চাই!

Comments