বাঙলাদেশের অজস্র সুন্দর সৃষ্টি রয়েছে। কিন্তু আমাকে যদি বলা হয় সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা বেছে নিতে? আমি চোখ বন্ধ করে বাংলাদেশের 'জাতীয় সংগীত' বেছে নেবো।
জাতীয় সংগীত আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা সর্বপ্রথম একসাথে গেয়েছিলাম ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে। ঐদিন আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করার শপথ নিয়েছিলাম।
সেদিনের জাতীয় সংগীতে কোনো সুর, স্কেল ছিলো না। কিন্তু মুক্তিকামী মানুষ হৃদয়ের গভীর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয়ে জাতীয় সংগীত গেয়েছিলো। এই জাতীয় সংগীত ছিলো আমার মুক্তি সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
এরপর জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী। বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রিয় মাতৃভূমিতে স্বদেশ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলো। রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ বাঙালি অপেক্ষা করছিলো বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১০ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে গেলেন। তার সাথে দাঁড়িয়ে গেলো সমস্ত জনতা। জাতীয় সংগীতের একটি করে লাইন গাওয়া হচ্ছে আর বঙ্গবন্ধুর চোখ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টির মত পানি ঝড়ছে। বঙ্গবন্ধুর চোখে জল তাই সমস্ত জনতার চোখে জল। কি অভূতপূর্ব দৃশ্য!
অবশ্য এই জাতীয় সংগীতের বিশালতা, গভীরতা, নান্দনিকতা জহির রায়হান খুঁজে পেয়েছিলেন দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই। জহির রায়হান ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তার বিখ্যাত 'জীবন থেকে নেওয়া' কাহিনীচিত্রে এই গানের মাধ্যতে প্রথম চলচ্চিত্রায়ন করেন।
বলাবাহুল্য ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের অনুষ্ঠান শুরুতে এই সংগীত পরিবেশন করা হয়। যদিও সেদিন সেটা অফিসিয়াল ছিলো না।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র তিনদিন পর ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার গানটির প্রথম দশ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন (মোট চরণ সংখ্যা পঁচিশটি) এবং যন্ত্রসঙ্গীতে ও সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয় প্রথম চারটি লাইন। সুরকার 'অজিত রায়' গানটির বর্তমানে প্রচলিত যন্ত্রসুর করেন।
আমাদের জাতীয় সংগীত আমাদের যেন অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। প্রত্যেকদিন সকালে প্রতিটি স্কুলে জাতীয় সংগীত পরিবেশনা শুনলে যেন শরীরটা শিউরে উঠে। নতুন প্রাণের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
সুরকার ইমতিয়াজ বুলবুল তার হার্টের বাইপাস অপারেশনের সময় বুকে জাতীয় পতাকা এবং কোরআন শরীফ রেখেছিলেন। অপারেশন সফল হওয়ার পর চেতনা ফিরলে তিনি শুরুতেই তার কনসাল্ট ডাঃ ফারহানাকে বলেন, 'দয়া করে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটা আমাকে শোনানোর ব্যবস্থা করুন।'
প্রয়াত রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু স্যার দেশের বাইরে শতশত কনসার্ট করেছেন। কিন্তু প্রত্যেকটি কনসার্টের শেষে তিনি বাজিয়ে দিতেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। পুরো অডিয়েন্স একসাথে গাইতো সেই গান।
বছরখানেক আগে বাংলাদেশের মেটাল ব্যান্ড Trainwreck জার্মানির ওয়েকেন মেটাল ফেস্টিভালে তাদের ইন্ট্রো শুরু করেছিলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দিয়ে। তাদের শরীরে ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। জার্মানির মাটিতে একটা মেটাল ব্যান্ড বাংলাদের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করছে আর দর্শক সেটা উপভোগ করছে। গর্বের বিষয় বটে।
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয় বড় ভক্ত। রবি ঠাকুরের সমস্ত গান, কবিতা একদম তার মূখস্ত। হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'আমার মনে হয় বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবচেয়ে সেরা সৃষ্টিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছে।'
বাংলাদেশ ক্রিকেট যখন স্টেডিয়ামে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে তখন আমার শরীরের প্রতিটি পশম দাঁড়িয়ে যায়। চোখ বেয়ে অজান্তেই পানি নেমে আসে। আমার মনে হয় প্রত্যেকের একই অনুভূতি হয়।
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত একজন বাংলাদেশি ভারোত্তলক। তিনি ২০১৬ দক্ষিণ এশীয় গেমসে স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাকে যখন বিজয়ীর মঞ্চে স্বর্ণপদক দেওয়া হয় তখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সেই মূহুর্তে মাবিয়া তার চোখের জল আটকাতে পারে নি। হুহু করে কেঁদেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সাথে।
আমার খুব ইচ্ছা বাংলাদেশ ফুটবল একদিন ফিফা বিশ্বকাপে ফুটবলে জায়গা করে নিবে। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে পরিবেশিত হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আহা! কল্পনা করতেই গা শিউরে উঠে। বিশ্বাস করেন আমি সেদিন হুহু করে কেঁদে উঠবো।
২০১৪ সালে ২৬শে মার্চ জাতীয় সংগীতকে ভালবাসা ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন জমায়িত হয় জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। আড়াই লক্ষ মানুষ একসাথে গেয়ে উঠে আমাদের প্রিয় জাতীয় সংগীত। যা ছিলো পৃথিবীতে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি।
কারণ আমার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আবেগ, ভালবাসা আর অস্তিত্বের প্রতীক। আমার কাছে মনে হয়, এতো সুন্দর মায়াবী জাতীয় সংগীত হয়তো পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশের নেই। এই সংগীতের প্রেরণায় এতো সংগ্রাম, প্রাণঢালা ভালবাসা হয়তো আর কোনো দেশের নেই।
স্রোতাদের পছন্দানুসারে বিবিসি বাংলার তৈরী সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি প্রথম স্থান দখল করে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশ নেয়া ২০৫ টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের তুলনামূলক বিচারে দৈনিক গার্ডিয়ান পত্রিকার মতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত দ্বিতীয় হয়।
"মা তোর বদন খানি মলিন হলে
আমি নয়ন,
ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি
সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি"

Comments
Post a Comment